Wednesday, November 25th, 2015




বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন সরকারি দলের আধিপত্য আরো পাকাপোক্ত করবে

 

ইতিমধ্যে মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যে এখন থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নিয়ে ইতিমধ্যে এই সিদ্ধান্ত ‘অর্ডিনেন্স’ হিসাবে আইনেও পরিণত করা হয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনও নড়াচড়া শুরু করেছে। ‘অর্ডিনেন্স’টি পাকাপোক্ত হলে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত আচরণ বিধিসহ প্রয়োজনীয় বিধানের আওতায় আগামীতে ১১টি সিটি কর্পোরেশন, ৩১৫টি পৌরসভা, প্রায় ৫০০ উপজেলা এবং সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আসছে ডিসেম্বর থেকে প্রায় আড়াইশত পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ক’বছর আগে থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বললেও মন্ত্রীপরিষদ অনেকটা আকস্মিকভাবেই নতুন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সরকার বা নির্বাচন কমিশন সংসদের ভিতরে-বাইরে রাজনৈতিক দল, নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ-প্রতিষ্ঠান, এই সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ও জনগণের কোন মতামত নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। চরম স্বেচ্ছাচারী পন্থায় আমলাতান্ত্রিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক দলসহ সবার মতামত ও পরামর্শ নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।
পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু যে শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সঙ্গত কারণেই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্ন ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। একথা নিশ্চয় সত্য যে, বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক পরিবেশ ও এককেন্দ্রীক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কাঠামোয় দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন তৃণমুল পর্যায়ে সরকারি দল ও জোটের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় দলীয়করণ ও দলবাজির বিপদ আরো বৃদ্ধি পাবে; সহিসংতা ও হানাহানিও বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার ও সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব আরো নিরংকুশ হবে। নিজেদের ভুল রাজনৈতিক কৌশল ও সরকারি দমন-নিপীড়নের মুখে সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ ও দিশেহারা তখন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে সরকার ও সরকারি দলের আধিপত্য আরো পাকাপোক্ত করবে তা নিয়ে সচেতন কারই সংশয়ের অবকাশ নেই।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ এর ভোট, ভোটার ও অধিকাংশ আসনে প্রার্থিহীন একটি অগ্রহণযোগ্য বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন এবং এ বছরের ২৮ এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের করুণ অভিজ্ঞতা, বর্তমানে জনগণের ভোটের অধিকারই যেখানে কার্যতঃ অস্বীকৃত, এরকম পরিস্থিতিতে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত, অবাধ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং সম্ভব স্বল্পতম সময়ে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনই যেখানে এ মুহুর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় সেখানে এই মূল কাজে হাত না দিয়ে সরকারের বর্তমান উদ্যোগ-আয়োজন যে সরকারের অনুকুলে দেশের সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামো ঢেলে সাজানো ও তাদের ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার ‘মাস্টারপ্লানের’ অংশ রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের তা না বোঝার কথা নয়।
তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র-গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের কোন বিকল্প নেই। তার জন্য স্থানীয় সরকারকে হতে হবে স্বশাসিত, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও ক্ষমতাসম্পন্ন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী জরুরী ছিল কার্যকরি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিদ্যমান সমগ্র ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা; যাতে মানুষ নিজেদের সবচেয়ে কাছের সরকার হিসাবে তার সুফল পেতে পারে। বাস্তবে এই ব্যাপারে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কোন মনযোগ নেই।
এ কথাতো সত্য আমাদের স্থানীয় সরকারসমূহ নামে ক্ষমতাসীন, কিন্তু কাজে ক্ষমতাহীন। প্রয়োজনীয় ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদসহ তারা কেবল কাগজে-কলমে স্থানীয় সরকার। উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্তৃত্ব ইউএনও-কে কেন্দ্র করে। আর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসাবে কর্তৃত্ব করছেন সরকারি দলের নেতারা। এর উপর রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের উপর সংসদ সদস্যদের খবরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব। সংসদ সদস্য হিসাবে আইন প্রণয়ন ও বাজেট নির্ধারণে প্রয়োজনীয় সময় ও মনোযোগ না দিয়ে সংসদ সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন এলাকার কথিত উন্নয়নের নামে গম, টিন, অর্থসহ সরকারি বরাদ্দের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। এইভাবে সংসদ সদস্যদের খবরদারি এবং সরকারের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কারণে স্থানীয় সরকারসমূহ দুর্বল, পঙ্গু ও অকার্যকরি হয়ে আছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে তার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে না পারলে স্থানীয় সরকার বা তার নির্বাচন নিয়ে যতই মাতামাতি করা হোক না কেন বাস্ততে তাতে তৃণমুল পর্যায়ে উন্নয়ন-অগ্রগতির নেতৃত্ব দানকারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকরি স্থানীয় সরকার বলে কিছু গড়ে উঠবে না।

তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেবল দলসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আমাদের বহুত্ববাদি রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোয় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, দায়িত্বশীল ও সক্রিয় রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন রয়েছে। তাদেরও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা উচিত। এর বাইরেও রয়েছে অনেক জনদরদি, নিবেদিতপ্রাণ, জনপ্রিয় মানুষ, যারা কোন দল করেন না। তাদেরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ রাখা প্রয়োজন। এমন কোন শর্ত আরোপ করা উচিত হবে না যাতে এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না বা প্রার্থী হওয়া দুস্কর হবে।

আর তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে স্বশাসিত, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি কেননা স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অনাকাংখিত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব, স্থানীয় সরকার পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগের বিধান এবং সর্বপরি স্থানীয় সরকারের উপর সংসদ সদস্যদের খবরদারি ও কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে।
কোন বাধা ছাড়াই কেন্দ্রীয় বরাদ্দে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করে বাজেট প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহে স্থানীয় সরকারকে নির্দিষ্ট এখতিয়ার প্রদান করা দরকার। প্রতিমাসে স্থানীয় সরকারের কাজের বিবরণী বাধ্যতামূলকভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করার এবং প্রতি তিন মাস পরপর তাদের কর্মকান্ডের উপর গণশুনানীর আয়োজন করার ব্যবস্থা রাখাও জরুরী। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে বর্তমান অকার্যকরি ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তবেই আশা করা যাবে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অপরাপর দলসমূহ পার্টির নিজস্ব দলীয় নির্বাচনী প্রতীক দিয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও অংশগ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহন করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category